মহাভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে - কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ

মহাভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে? একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। মহাভারতে অগনিত যোদ্ধাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বেছে নেওয়া সত্যি দুষ্কর। কারণ শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা শুধু বাহুবলেই বেছে নেওয়া যাবে না, থাকতে হবে কপটতা, কৌশলতা, গভীর যুদ্ধবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, দিব্যাস্ত্র প্রয়োগে সক্ষমতা, নীতি, প্রজ্ঞা আরও অনেক গুণ। মহাভারতের বড় ও শ্রুত যোদ্ধাদের তালিকা বেশ লম্বা। তাদের মধ্যে মহামহিম ভীষ্ম, কর্ণ ,অর্জুন, গুরু দ্রোণ, ভীম, অশ্বথামা, ঘটোৎকচ, দূর্যোধন সহ আরো অনেক অশ্রুত যোদ্ধা। তাহলে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে?
মহাভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে
মহাভারতের অসংখ্য যোদ্ধাদের মধ্যে দুইজনকে আলাদা করা যায় সহজেই। তারা হলেন দেবরাজ ইন্দ্রপুত্র মহাবীর অর্জুন এবং সূর্যদেবের আশির্বাদে কুমারী কুন্তিপুত্র কর্ন। কর্ন ও অর্জুনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ

অঙ্গবীর কর্ণকে অনেকেই এগিয়ে রাখেন, তার অন্যতম কারন হলো অর্জুনের কৃষ্ণ নির্ভরতা। অপরদিকে কর্ণ ছিলেন দূর্যোধনের প্রধান যোদ্ধা। বলা যায় দূর্যোধন খোদ নির্ভর করতেন কর্ণের উপর। যুদ্ধে অর্জুন কর্ণ মুখোমুখি হলে প্রথমে অর্জুনের তীরে কর্ণের রথ কয়েকগজ পিছিয়ে যায়। তারপর কর্ণের তীরে অর্জুনের রথ ও অল্প পিছিয়ে যায়। কিন্তু এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের কৃতিত্ব বেশি বলে যুক্তি দেন। কারণ অর্জুনের রথে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বসে আছেন, হনুমান আছেন তবুও কর্ণ রথটিকে পিছিয়ে দেন। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে কর্ণের মৃত্যুও ছিল অদ্ভূত। তবে তার মৃত্যুর কারণ তার যোগ্যতাহীনতা নয় , তার দানশীলতা এবং পরশুরাম কর্তৃক প্রদত্ত অভিশাপ। অর্জুনের হাতে কর্ণকে বধ করনোর উদ্দেশ্যে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণের কর্ণের কাছ থেকে তার কবচ ও কুন্ডল ভিক্ষা করে নিয়েছিলেন যা কর্ণকে দূর্বল করে তুলেছিল। এই কবচ কর্ণের শরীরে থাকলে অর্জুনের তীর তার বক্ষকে কোনোভাবেই বেধ করতে পারতো না। কর্ণের মৃত্যুর ২য় কারণ ছিলো তারই গুরুদেব পরশুরামের দেওয়া অভিশাপ। নিজের পরিচয় গোপন রেখে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা নিয়েছিলেন বলে তিনি কর্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন প্রয়োজনের সময় কর্ণ দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান ভুলে যাবেন। আর ঠিক এই কারণেই অর্জুনের সাথে যুদ্ধের সময় দূর্ভাগ্যবশত কর্ণের রথের চাকা মাটিতে আটকে যায়, তখন তিনি কোন দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান স্মরণ করতে পারেননি, এবং এই বীর যোদ্ধার মৃত্যু হয় নিরস্ত্র অবস্থায়।

আবার কর্ণের কাছে কবচকুন্ডল থাকা সত্বেও তিনি দ্রুপদের কাছে হেরেছেন। মহাভারতের আদিপর্বে অর্জুনের কাছে পূর্বে একাধিকবার হেরেছেন, ভীমের কাছেও হেরেছিলেন কর্ণ । গন্ধবরাজ চিত্রসেনের কাছেও হেরেছিলেন। অপরদিকে অর্জুন দ্রুপদ ও চিত্রসেন দুজনকেই পরাজিত করেছেন। অর্জুনের কৃতিত্বের তালিকাটা আরও দীর্ঘ। তিনি দ্রুপদকে বন্দি বানিয়েছিলেন, কর্ণ পারেননি। মানুষের অগম্যস্থানে গিয়ও জয়লাভ করে এসেছেন। খাণ্ডবপ্রস্থ দহন করতে গিয়ে তিনি দেব, লোকপাল, দিকপাল, দানব সবাইকে পরাজিত করেছেন। মহাদেবকে যুদ্ধে সন্তুষ্ট করেছেন। নিবাতকবদের পরাজিত করেন, দেবতারাও তাদের পরাজিত করতে পারেননি। তারপর কালকেয়দের বধ করেছিলেন। বিরাট যুদ্ধে তিনি একা ভীষ্ম, দ্রোনাচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণ, অশ্বথামা, দুর্যোধন, দুঃশাসনকে পরাজিত করেছিলেন। আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহারথীদের মধ্যে তিনি একা আর বিপক্ষে ভীষ্ম, দ্রোন, কর্ণের মতো মহাযোদ্ধারা। সেটাও কি কম কৃতিত্বের। তাই কর্ণের থেকে অর্জুনই শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। তবে কর্ণের সঙ্গে যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে, তাতে তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তা বাহবা পায়। যেমন বাহবা পেয়েছিলেন কৃষ্ণেরও।

আবার পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলাই যায় যে অর্জুন ,কর্ণ দুজনেই সমান যোগ্যতা সম্পন্ন যোদ্ধা। কিন্তু কর্ণকে প্রথমে না রেখে অর্জুনকে প্রথমে রাখা হলো কারণ ২ টি । প্রথম কারন কর্ণ ছিলেন অধর্মের পক্ষে আর অর্জুন ধর্মের পক্ষে। আর ২য় কারণ ইতিহাস সবসময় বিজয়ীর হাতেই লেখা হয়। আর মহাভারতের চেয়ে বড় আর গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আর কি হতে পারে।

শ্রীকৃষ্ণকে কেনো শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলা হবে না?

এটি একটি গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন। তার সামান্য ইশারাতেই তো সম্পূর্ণ ব্রম্মান্ডে প্রলয় নেমে আসতে পারে। মুলত মহাভারতের দুইপক্ষের যুদ্ধ ছিলো মুলত ভগবানেরই লীলাখেলার অংশ। তাই তিনি এই আলোচনার বাইরে।

দাতা কর্ণ কে ? কর্ণের গুরু কে ছিলেন

মহাভারতের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র মহাবীর কর্ণই দাতাকর্ণ নামে পরিচিত। নিজের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যিনি প্রাণরক্ষাকারী কবচ-কুণ্ডল দান করতে দ্বিধা করেননি, তিনিই হলেন কর্ণ। তিনি জন্মেছিলেন স্বর্ণময় কবচ-কুণ্ডল নিয়ে। সূর্যাকৃতির কবচ-কুণ্ডল গুণে তিনি ছিলেন অপরাজেয়।কর্ণ ছিলেন সূর্যদেব ও কুন্তীভোজের পালিত কন্যা রাজকুমারী কুন্তীর সন্তান এবং সেই সূত্রে পাণ্ডবদের বড় ভাই। বিয়ের আগে কর্ণের জন্ম হওয়ায় কুন্তী লোকনিন্দার ভয়ে শঙ্কিত হয়ে সমাজে নিজের সম্মান রক্ষার তাগিদে শিশুপুত্রকে একটি বেতের পেটিকায় শুইয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন।ভীষ্মের রথের সারথি অধিরথ ও তাঁর স্ত্রী রাধা দেবী তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁরা কর্ণকে পুত্রস্নেহে পালন করেন।

বাল্যকাল থেকে কর্ণ ধনুর্বিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি কুরুরাজকুমারদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষালাভ করেন। যদিও তার মূল গুরু হলেন পরশুরাম। বাল্যকাল থেকে কর্ণ ধনুর্বিদ্যায় আগ্রহী ছিলেন। তিনি কুরু রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে গেলে, দ্রোণাচার্য তাঁকে সুতপুত্র বলে প্রত্যাখ্যান করেন। দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যানের পর কর্ণ দ্রোণাচার্যের গুরু পরশুরামের নিকট শিক্ষাগ্রহণের জন্য যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরশুরাম যেহেতু শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের শিক্ষা দিতেন, তাই কর্ণ নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসাবে পরিচয় দেন। অতঃপর পরশুরাম তাঁকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনি কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্র ত্যাগ ও অস্ত্র সংবরণ করার পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। শিক্ষার শেষে পরশুরাম তাঁকে নিজের সমতুল্য যোদ্ধা ও ধনুর্বিদ বলে ঘোষণা করেন।

শেষ কথাঃ মহাভারতকে সংহিতা অর্থাৎ সংগ্রহগ্রন্থ এবং পঞ্চম বেদ স্বরুপ ধর্মগ্রন্থ বলা হয়। যেসকল খন্ড খন্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য পুরাকালে(প্রাচীন কালে) প্রচলিত ছিল তাই সংগ্রহ করে মহাভারত সংকলিত হয়েছে। এতে ভগবদগীতা প্রভৃতি যেসকল দার্শনিক সন্দর্ভ আছে তা আধ্যাত্মবিদ্যাথীর অধ্যয়নের বিষয়। প্রত্নতাত্ত্বিকের কাছে মহাভারত অতি প্রাচীন সমাজ ও নীতি বিষয়ক তথ্যের অনন্ত ভান্ডার। ভূগোল জীবতত্ত্ব পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রাচীন ধারণা কি ছিল তাও এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়।
নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম